সময়ের সাথে মানুষের চোখের স্বপ্ন বদলে যায় ব্যাপকভাবে। কখন ফুলের মত বেগুনী, কখন বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির মত সবুজ কিংবা কখন তুষাররুপ সাদা। সব রঙয়েরই আলাদা রূপ, আলাদা প্রেক্ষাপট। এবারের স্বপ্ন ছিল সাদাটে, যা কিছুটা শান্তির এবং কিছুটা অনিশ্চয়তার।
স্বপ্নটা জোরালো হয় কাছের কিছু মানুষের সাথে মাউন্ট কানামো সামিটে যেতে না পারা থেকে। তাদের ফেরার পর পরিকল্পনা শুরু হয়, শুরু হয় সবকিছু গুছানো। টার্গেট ছিল Mt. Kanamo। খোঁজ খবর লাগানোর মাঝেই জানতে পারি সামিট রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এ বছরের জন্য, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অসমর্থিত সূত্রে আসা কিছু পরিবেশজনিত কারণে। পরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য প্রথমে আসে Mt. Yunum এর কথা, যা ২০১০০ ফুট উপরে অবস্থিত। ২০১৯ সালে পাহাড়ের ভারসাম্যহীন আবহাওয়া, অভিজ্ঞ সহযাত্রী এবং সাদা পাহাড়ের দিকে প্রথম যাত্রা। সবকিছু মিলিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীদের সতর্কতামূলক বার্তা বার বার একটা কথা মাথায় খেলাতে থাকে, সেটা হইল “পাহাড়কে জয় করা যায় না, ভালবাসতে হয়।” যার সাথে যোগ দেয় আবহাওয়াজনিত কারণে বিভিন্ন পাহাড় থেকে সামিট না করে ফিরে আসা অনেক ভাইয়ের খবর।
পরবর্তীতে কথায় কথায় এক ভারতীয় থেকে জানতে পারি Mt. Bhrigu এর কথা। যেটি হিমাচল প্রদেশে ১৪১০০ ফুট উপরে অবস্থিত। যার প্রধান আকর্ষণ পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রায় ২০০-৩০০ফুট নিচে অবস্থিত ছোট্ট লেক। যার জন্য এই ট্রেকের নাম হয়েছে “Bhrigu Lake Trek”। সময়ের সাথে এই ভৃগু ট্রেকের রুপও পরিবর্তন হয়ে যায়। জুন-সেপ্টেম্বর পুরো পাহাড় ভরে উঠে সবুজ ঘাস এবং রঙবেরঙের ফুলে সাথে থাকে মেঘ-বৃষ্টির খেলা, এবং এটাকেই ট্রেকের সঠিক সময় ধরা হয়। অক্টোবর- নভেম্বর ঘাস শুকিয়ে পাহাড় নেড়া হতে শুরু করে এবং উপরের দিকটা বরফে ঢাকতে শুরু করে। এ সময় জায়গা ভেদে তাপমাত্রা +১৫ থেকে -১০ এর মাঝে থাকে। একেবারে উপরের দিকেও মাইনাস তাপমাত্রা বিরাজ করে। অক্টোবর থেকেই এই রুট বন্ধ হতে শুরু করে। নভেম্বর থেকে প্রচন্ড ঠান্ডা এবং খাড়া পাহাড়টি বরফে ঢেকে যায় বলে রুটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, যদিও কেউ চাইলে নিজ দায়িত্বে যেতে পারে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পাহাড়টি সাদা বর্ণে রূপান্তরিত হয়।
আমাদের যাত্রাঃ
আমরা ৩ জন ২০তারিখ রাতে ঢাকা থেকে কলকাতা রওনা হই। কলকাতা থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেসে দিল্লি গিয়ে পৌঁছাই ২২ অক্টোবর সকালে, দিল্লি থেকে ঐ রাতের বাসেই রওনা হয়ে স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু মানালিতে পৌছাই আনুমানিক ১০টার দিকে। মানালি ঢোকার পথে দূরের পাহাড়গুলোর শ্বেত-শুভ্র রূপ আমাদের স্বপ্নকে আবার সাদাতে রূপান্তরিত করা শুরু করে।
মলরোডে গিয়ে দালাল ছাড়াই খুঁজে ৫৫০ রুপিতে রুম নিয়ে নেই তিনজনে জন্য।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐদিন মানালিতে হাঁটাহাঁটি করলাম। ২-৩ দফা স্নোফল হওয়াতে অনেক এজেন্সিই তাদের ক্যাম্প গুঁটিয়ে ঐ রুটে ট্রেক বন্ধ করে দিয়েছে এই বছরের মত। খুঁজতে খুঁজতে পেলাম মনের মত একটা এজেন্সি, যারা আমাদের ভৃগু ট্রেকটিতে সাথে থাকবে। যাত্রা শুরু হবে ২৩ অক্টোবর সকালে ৯.৩০ এ।
পরদিন সকাল সকাল উঠে ব্যাগ গুছিয়ে বেড়িয়ে যাই, হালকা নাস্তা করতে করতে আমাদের গাইড সুরাজ চলে আসে। খুবই ভদ্র, চুপচাপ টাইপের একটা ছেলে। ১০.১৫ এর দিকে আমাদেরকে গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কুলাং নামের স্থানে। যেখান থেকে শুরু হবে আমাদের পদযাত্রা। সবাই দ্রুত প্রস্তুত হয়ে শুরু করলাম সোজা উপরের দিকে উঠা।
কুলাং আনুমানিক ৬৬০০ ফুট উপরে অবস্থিত। প্রথমে কিছু ঘরবাড়ি, তারপর বাগান, তারপরই শুরু হয়ে যায় বিশাল পাহাড়ের পাহাড়ি পাথুরে পথ। যতই উপরে উঠছিলাম ছোট হয়ে আসছিল দুনিয়া। দূর থেকে ছোট হয়ে আসছিল সোলাং ভ্যালী সহ আশপাশ। আনুমানিক ৩-৩.৩০ ঘন্টা খাড়া উপরের দিক উঠার পর পাওয়া যায় কিছুটা সমান রাস্তা। আস্তে আস্তে নিঝুম হয়ে যাচ্ছিল পরিবেশ, নিজেদের হাঁটার শব্দ বাদে কিছুই নাই মনে হচ্ছিল। ঘন জঙ্গলের মাঝে শুকনা পাতার শব্দ, মাঝে মাঝে মাঝারী কিছু ঝর্ণার গান তাড়িয়ে দিচ্ছিল সব ক্লান্তি।
খানিককাল বাদে দূর থেকে দেখা মিলল ঘন জঙ্গলের মাঝে কিছু তাবু। তার মানে পৌছে গিয়েছি আমাদের বেসক্যাম্পে। জায়গাটা মরিডক নামে পরিচিত। ততক্ষণে বিকেল হয়ে গিয়েছিল, সূর্যি মশাই লুকোচুরি খেলছিল পিছনের দিকের মাউন্ট হনুমান টিব্বার(৫৯৮২মি.) পর্বতসমুহের সাথে। ব্যাগ রেখেই বিশ্রাম নিয়ে নিলাম গরম কফির সাথে। এমন ঠান্ডা এবং মনোরম পরিবেশে কফিটা স্বর্গীয় কোন পানীয় লাগছিল। ততক্ষণে ঠান্ডাও পড়া শুরু করেছে খুব। তাও নিজেদের মানিয়ে নিতে সন্ধ্যার ঠিক আগেই বের হলাম একটু হাটাহাটি করে নিতে। সন্ধ্যার ঐ মুহূর্তটি ভুলবার মত না। আধার নামতেই আমাদের গাইড আমাদের ক্যাম্পে চলে যেতে বলতে থাকে, কারণ এই ঘন পাইন বনে থাকে অনেক হিংস্র প্রাণী।
আকাশ ভর্তি তারা দেখতে দেখতে প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝে রাতের খাবার খেয়ে নেই। ৮টা বাজতেই তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাসে। সব গুছিয়ে আমরা শুয়ে যায় পরের দিনের পরিকল্পনা করে নিয়ে। রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় -০৬ এ সাথে ছিল বাতাস। তাবুর বাইরে ঘাসের মাঝে ছোট বড় বরফের অস্তিত্ব দেখে বুঝাই যাচ্ছিল ঠান্ডার উপস্থিতি।
সকাল সকাল উঠে নিজেদের মত প্রস্তুত হয়ে যাই আমরা। রাতে অসাবধানতার কারণে রগে টান খাওয়ার পায়ে কিছুটা ব্যাথাটা বেড়ে গিয়েছিল। নাস্তার পর ওষুধ খেয়ে বের হয়ে পরি ৮টার দিক সামিট টার্গেট ভৃগু লেকের দিকে। একেবারে খাড়া উপরের দিক উঠতে হবে প্রায় ৫০০০ ফুট। পা এর ব্যাথা বার বার বলছিল ফিরে যেতে ক্যাম্পে, কিন্তু মনেরশক্তি বলছে না এগিয়ে যাও। আল্লাহর নামে শুরুই করে দিলাম উঠা।
শুরুতেই পড়ল ঘন পাইন বন। অনেক ঘন বনের মাঝে দিয়ে উঠতে থাকি উপরের দিকে, খানিকটা পর দেখা মিলল এক জার্মানি দম্পতির সাথে। তারা আগের দিন সামিট করে আজ নিচে নেমে যাচ্ছে, তাদের বেসক্যাম্প ছিল খানিকটা উপরে। গা ছম ছম করা পাইন বনের মাঝে দিয়ে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছিল উপরের ন্যাড়া রুক্ষ পাহাড়। অতি উৎসাহে গাইডকে জিজ্ঞাসা করে বসি ওটাই কি আমাদের লক্ষ্যের চূড়া? যার মানে চলে এসেছি প্রায় ৪০% যদি ওটা লক্ষ্য হয়। কিন্তু করুণ ভাবে সে জানালো না। ওটা ১ম ধাপ। ওটার আরো পরে আসল লক্ষ্য। তখনো ৫ ভাগও পার হই নাই!! বেশ কিছু সময় পার করে আমরা বের হয়ে পরি বন থেকে, এখন সামনে শুধু ন্যাড়া পাহাড়। এই পাহাড়ের অংশটা জুন জুলাই মাসে ভরে যায় নানা রংয়ের ফুলে। বেশ কিছু সময় পর কিছু মানুষের দেখা! এক নেপালি, দুই ভারতীয়। ন্যাড়া পাহাড়ে শুয়ে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার উঠা শুরু করলাম। একটু পর পরই চোখে পড়ছিল বড় বড় পাথর। আর দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল সাদা বরফের ছোপ ছোপ আবরণ। বেশ খানেকটা উঠে আনুমানিক ১২০০০ফুটের আশেপাশে, উচ্চতা জনিত কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। প্রচন্ড বাতাস, ঠান্ডা এবং অনেকটুক খাড়া উঠে আসা সব মিলিয়ে উঠে পরে লেগেছিল আমাদের পিছে।
একটু বিশ্রাম এবং দুপুরের খাবার খেয়ে আবার রওনা দিলাম। ততক্ষণে দূরের হনুমান টিব্বা পাহাড়ের চূড়া ঢেকে গিয়েছিল ঘন মেঘে। দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তনের ভয় এবং গাইডের সেই মহৎ বানী “এই যে সামনে পাহাড়ের পরেই”; শুনে শুনে এগুতে থাকি ক্লান্ত শরীরে হেলে দুলে। ইতিমধ্যে আমরা ঢুকে পড়ি সাদা বরফের রাজ্যে। বড় বড় পাথরের মাঝে মাঝে বরফ পরে সমান একটা রাস্তার রূপ দিলেও ছিল প্রচুর বিপদজনক। দুই পাথরের মাঝে পা পরতেই পা ঢুকে যাচ্ছিল বরফের মাঝে। আস্তে আস্তে দেখে শুনে এগুতে থাকি আমরা। এর মাঝেই আবহাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠে। বাতাসের বেগ বেড়ে যায় দ্বিগুণ, মেঘের ভেলাটা এসে পরে আমাদের কাছেই। প্রতিটা বড় বড় চড়াই পার হয়েই মনে হচ্ছিল যে এখনই বুঝি চোখের সামনে দেখব আমাদের লক্ষ্যটা। কয়েকবার ধোকা খাওয়ার পর অবশেষে দেখা পাওয়া তাহার। দেখেই শরীর ছেড়ে দিতে চাইছিল, মনে হচ্ছিল কেও কানে এসে বলছে “চলে এসেছিস, এবার একটু ঘুমা”।
উচ্চতা, বৈরি আবহাওয়া, প্রচন্ড ঠান্ডা, ক্লান্তি সব মিলিয়ে সবারই কথা জড়িয়ে আসছিল। লেকের সামনে পেয়ে ভালো লাগা, খারাপ লাগা এবং জয়ের অনুভূতি কোনটাই প্রকাশ করার ভাষা আজও মাথায় আসে নি!! সকাল ৯টায় রওনা হয়ে প্রায় ৫০০০ফুট উঠে আমরা বেলা ০৩.১৫ ঘটিকা দিক পৌছাই আমাদের লক্ষ্যে।
নিজেদের মত বিশ্রাম এবং সময় কাটিয়ে প্রচন্ড বাতাসের জন্য বেলা ০৩.৫০ ঘটিকার মাঝেই রওনা দেই বেসক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। সাথে ছিল আবহাওয়া আরো খারাপের ভয়, সন্ধ্যে নামলে ঘন পাইন বনের হিংস্র পশুদের ভয় এবং একরাশ স্মৃতি!!
কিছু সময়ের মাঝে মেঘে ঢেকে যায় আমাদের চারপাশ, সাথে শুরু হয় স্নো-ফল। সময় না থাকায় কোনভাবেও না থেমে নামতে থাকি খাড়া ঢাল বেয়ে। পায়ের ব্যাথাটা ততক্ষণে ভালো করে পেয়ে বসেছিল আমার। তাও মেলা কষ্টে সবার সাথে তাল মলিয়ে নামতে থাকি। বেশি খাড়া হওয়ায় একটু অসাবধানতাই এনে দিতে পারত চরম খারাপ পরিণতি। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথেই আমরা ঢুকে পরি ঘন বনে। অন্ধকারের এই পাহাড়ের রূপটা ছিল অনেক ভয়াবহ এবং গা ছমছমে। পথ যেন শেষই হতে চাইছিল না। কিছুটা নেটওয়ার্ক পাওয়া যেতেই বেসক্যাম্পের থেকে একের পর এক ফোন আসছিল গাইডের কাছে। তারাও টেনশন করছিল আমাদের জন্য। বুঝছিলাম বনটা দ্রুত পার হওয়াটা খুবই জরুরি, তাই সবাই সারাদিনের ক্লান্তির পরও নিজেদের সেরাটা দিয়ে প্রচুর দ্রুত বেগে নেমে অনুমানিক ৭টার দিক ক্যাম্পে ফিরে আসি। ক্যাম্পে গিয়েই টাবুর সামনে রাখা কিছু গাছের কাঠ দিয়ে বানানো অস্থায়ী ব্যাঞ্চে শুয়ে পরি। শুয়ে শুয়ে হাজার হাজার তারা দেখে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টায় ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ আকাশের তারা দেখে এবং ক্যাম্পফায়ারে আগুনের তাপ নিয়ে কিছুটা ভালই লাগছিল। যে যার মত ফ্রেস হয়ে চলে যাই রাতের খাবার খেতে। রাতে ছিল উৎযাপনের জন্য মজার মজার সব চাইনিজ খাবার। জীবনেও কল্পনা করতে পারি নাই এমন জায়গাতে আসে তারা দেখতে দেখতে স্যুপ, ফ্রায়েড্ রাইস, চাওমিনসহ এতগুলো পছন্দের খাবার একসাথে খাব। বেসক্যাম্পের নেপালি স্টাফগুলো আসলেই আমাদের ট্যুরটাকে অনেকড় বৈচিত্র্যময় করে তুলেছিল, কারণ পাহাড়ে উঠার জন্য খাওয়াটা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানালি সহ আশে পাশের শহরগুলোতে তখন চলছে দিওয়ালীর বাজি উৎসব। দূর এবং উপর থেকে কিছু বুঝা না গেলেও আতশবাজির আলো ঠিকই অনুভব করতে পারছিলাম।
বেসক্যাম্পে সবার সাথে আড্ডা দিতে দিতে বিদায়ের শেষ ঘন্টা দিচ্ছিলো আমাদের এই যাত্রা।পরদিন মানালি নেমে আসি, তারপর একে একে কুল্লু, দিল্লি, কলকাতা ঘুরে ১২দিন পরফিরে আসি বাংলাদেশে।
আমাদের মাউন্ট ভৃগু ট্রেকটা ছিল সম্পূর্ণ বৈচিত্রময় একটা সফর। রোদ, মেঘ, স্নোফল কিংবা পাথুরে পথ, ঘন পাইনবন, ন্যাড়া পাহাড়, রঙিন ঝর্ণা, বরফের রাজ্য!! কি পাইনি একটা সফরে।
Name- GOLAM MUKIT SARWAR
Profession- Civil Engineering
City- Dhaka, Bangladesh
Hobbies- Travelling, Mobile Photography
Previous Tours- Mt. Bhrigu Trek, Himachal Pradesh