“অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি, মাথাটা কাজ করছে না..…কোথাও একটা ঘুরতে যাওয়া হোক………|
এই লাইনটা বোধহয় সব বাঙালির ঘরের বার্ষিক প্রবচন,কারণ বাঙালির ভ্রমন পিপাসু জ্যাক স্প্যারো বা সিন্দবাদ-এর থেকে কোনো অংশে কম নয়| কিন্তু বাধ সাধছে স্বাদ আর সাধ্যের মাঝের ফাঁকা জায়গাটা| ল্যাদখোর বাঙালি হঠাৎ চনমনে হয়ে ওঠে ঘুরতে যাওয়ার নাম শুনে সে পুরী হোক বা দার্জিলিং বা পাহাড়ের অজানা দুর্গম বিপদ সঙ্কুল রাস্তার পদব্রজের হাতছানি|
যাইহোক ২০১৬ দূর্গাপূজার মৃন্ময়ীমায়ের বিসর্জন দিয়ে,মন খারাপ নিয়ে ফেরার সময় 4 বন্ধু মিলে [দ্বীপ(আমি),পৌলমী (আমার অর্ধাঙ্গিনী), সৌরভ, আর চৈতীপর্ণ (সৌরভের অর্ধাঙ্গিনী)] আড্ডা মারতে মারতে হঠাৎ কথা উঠলো মেঘের রাজ্য মেঘমা পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার সর্বোচ্চ শিখর সান্দাকফুর মাথায় দাঁড়িয়ে অপর পারে পাহাড় চূড়ায় শুয়ে থাকা বুড়ো অর্থাৎ স্লিপিং বুদ্ধ রেঞ্জ দেখার| সান্দাকফু থেকে পৃথিবীর সবথেকে উচ্চতম ৫টি শিখর এর মধ্যে ৪টি স্পষ্ট দেখা যায় : কাঞ্চনজঙ্গা, লহটসে, মাকালু এবং এভারেস্ট|
সারাবছর কলকাতার গরমে পচে যাওয়া বাঙালির পক্ষে ঠান্ডা পাহাড়ের লোনা সামলানো মুশকিল,তাই ঠিক হলো পরের ছুটিতেই আমরা রওনা দেব সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে| পরের ছুটি বলতে বড়দিন,তবে তাই সই, ঠিক হলো আমরা বড়দিনের আগের সপ্তাহে বেড়িয়ে পড়বো হাটা পথে সান্দাকফুয়ের উদ্দেশ্যে| ঘুরতে যাওয়ার সবথেকে দুরহ ব্যাপার আমার লাগে আই.আর.সি.টি.সি থেকে ওয়েটিং বা আর.এ.সি. ছাড়া একবারে টিকেট পাওয়া,তাই আর দেরি না করে চারমাথা এক হয়ে টিকেট বুকিং তক্ষুনি করা হয়ে গেলো আই.আর.সি.টি.সি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিউ জলপাইগুড়ির| এরপর খোঁজখবর নিয়ে একজন পরিচিত বন্ধুর সাহায্যে যোগাযোগ হলো যার নাম রাজীব লেপচা আর তার ছোট ভাই ভরত|
শুরুরআগে : গন্তব্য নিউ জলপাইগুড়ি
ট্রেকিং শুরু করার আগে কয়েকটা জিনিস মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন| ভালো রুকস্যাক, ভালো ট্রেকিং জুতো, ভালো হেলোফিল জ্যাকেট আর একটু ব্যায়াম ভীষণভাবে আবশ্যক ট্রেকিং করার জন্য| ল্যাদখোর বাঙালি তাই জিম গিয়ে ওঠা হলো না, কিন্তু রোজ সকালে একে ওপরকে তাড়া দিয়ে একটু হালকা ব্যায়াম ঘরে করা শুরু হয়েছিল সেই মাস দুয়েক| যদিও পরে গিয়ে টের পেয়েছি সেটা কতটা জরুরি ছিল| বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে বেশি আনন্দ বোধহয় যাওয়ার শেষ একমাস আগে ঘুরতে যাবো সেই ভেবেও।
যাইহোক প্রস্তুতি চলতে চলতে সেই আকাঙ্খিত দিন এসে গেলো, আমরা ৪ জন রাতের বেলা দার্জিলিং মেল-এ চড়ে বসলাম| উত্তেজনায় কি আর ঘুম আসতে চায় সহজে, তাই গল্প সেরে দেরী করে শুয়েও ঘুম আসলো শেষ রাতে| অপেক্ষায় ছিলাম কখন সেই উত্তর বাংলার প্রিয় শহর, হিমালয়ের পাদদেশে শিলিগুড়িতে পৌঁছবো, যার নাম শুনলেই ছোটবেলা থেকেই দার্জিলিং যাওয়ার কথা মনে পরে যায়।
প্রথমদিন: গন্তব্য মানেভঞ্জন
নিউ জলপাইগুড়িতে সকালবেলা নেমে আমাদের আগে থেকে বলে রাখা রাজীবদা একটা Bolero ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন| স্টেশন থেকে আমাদের গাড়ি পিক আপ করে এগিয়ে চললো সেই পুরানো সেবক রোড হয়ে মানেভঞ্জনের দিকে| মাঝে বার দুয়েক চা সহযোগে, ভোজন প্রিয় বাঙালির উদর শান্তি করে নিয়ে ঘন্টা ৫ এর মতো লাগলো মানেভঞ্জন পৌঁছতে| মানেভঞ্জনের মূল টাউন থেকে আধ কিলোমিটারের মতো দূরে আমরা থেকে ছিলাম একটা ফরেস্ট গেস্ট হাউসে| গাড়ি থেকে নামার পর হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়ায় হাড়ের ভিতর অবধি কেঁপে উঠলো| তাড়াতাড়ি গরম জামা পরে রুমের বাইরে আসতেই এসে গেলো ধোঁয়া ওঠা চা আর পিয়াজের পাকোড়া| পাহাড়ের ঢালে বানানো এই গেস্ট হাউসের রুমের বাইরে যে ছোট লন আছে তার পাথরে বাঁধানো চেয়ার বসে কাটিয়ে দেয়া যায় কয়েক ঘন্টা অক্লেশে| রুমের মধ্যে ছিল ফায়ারপ্লেস এবং বাইরে কাঠের স্তূপ, তাই সে রাত অগ্নিদেবের কৃপায় বিশেষ ঠান্ডা বোধ হলো না| প্রথম রাতে খুব উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও আমরা চটজলদি খেয়ে শুয়ে পড়লাম পরের দিনের হাঁটার কথা মাথায় রেখে|
দ্বিতীয় দিন: গন্তব্য টংলু
সকাল সকাল প্রাতরাশ সেড়ে আমরা প্রথমদিন প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে হাটা শুরু করলাম গাইড ভরতদার সাথে| প্রথম হল্ট হলো ২ঘন্টা চলার পর চিত্রে মনাস্টেরীর কাছে| গরম ম্যাগি আর কফি খেয়ে আবার চিত্রে থেকে হাঁটা শুরু হলো আধাঘন্টা পর। চিত্রের পরে শক্ত কংক্রিট রাস্তা ছেড়ে আমরা উঠে এলাম নরম ঘাসে মোড়া মেঘের দেশের গ্রাম মেঘমা| শীতের পড়ন্ত বেলায় এমনি ঘনমেঘ যে ১০ ফুট দূরে মানুষ অনায়সে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মেঘমায় গোটা ট্রেইলটি খুব অদ্ভুত, এই ইন্ডিয়াতে পা আছে আবার ১০ পা চলার পর নেপালে। যাইহোক মেঘের মাঝ দিয়ে নেপাল-ইন্ডিয়া করতে করতে প্রথম দিনের গন্তব্য টংলু পৌঁছতে প্রায় সন্ধে। টংলু তে ট্রেকার হাটে পৌঁছে শরীরে আর জোর বাকি নেই। রাতের খাওয়া সেড়ে সন্ধে ৮ টার মধ্যে বিছানায় ধরাশায়ী, আমার শহর কলকাতায় তখন তো সবে সন্ধে।
তৃতীয় দিন: গন্তব্য কালপোখরি লেক
পরের সকালে একমেঘে ঢাকা ভোরে ঘুম ভাঙলো গাইড ভরতদার ডাকে। ২ডিগ্রী টেম্পারেচার কম্বল থেকে ওঠা আর সামনের কাঞ্চনজঙ্গা ঠেলে সরানো দুটোই একইরকম দুরূহ। যাইহোক, এডভেঞ্চারের লোভে বেরিয়ে থেমে যাওয়ার কোনো মানে নেই, তাই তেনজিং নোরগে'র নাম স্মরণ করে কাঁপতে কাঁপতে বিছানা থেকে নেমে পড়তেই ভরতদা গরম চা নিয়ে হাজির। চা ও প্রাতরাশ সেরে বেরোতে প্রায় ৭.৩০। ততক্ষনে সকালের চনমনে রোদ উঠে যাওয়াতে শরীর অবসাদ কেটে আমরা আবার প্রস্তুত। টংলু থেকে টুম্বলিং যাওয়ার রাস্তা পাহাড়ের একদিকে সকালের ভোরের সূর্য আর একদিকে শেষ ভোরের ঢোলে যাওয়া চাঁদ, উপরি পাওনা পুরো রাস্তাটা নরম হলুদ ঘাসে মোড়া | টংলু থেকে টুম্বলিং হয়ে আমরা ঘনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে নামতে শুরু করলাম সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, নিস্তব্দ প্রকৃতির মাঝে শুধু ভারী ট্রেকিং জুতোর নিচে শুকনো পাতার মুচমুচ করে গুড়িয়ে যাওয়ার শব্দ, পাখির কলতানে মুখর হয়ে যাওয়া বাতাস আর ঠান্ডা এক শান্ত হাওয়া। মানুষ বলতে আমরা ৫ জন শুধু,হাপিয়ে দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে হলে শুকনো পাতার বিছানায় শুয়ে পড়ছি। শুধু বেলা গড়িয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ভরতদার আওয়াজ...."চলতে রাহো, থোড়ি অর দূর হয়"। একটা জিনিস অনুভব করলাম প্রকৃতির এই পরিবেশের ক্ষমতা আছে যা মনের সমস্ত কলুষতাকে দূর করে দেয়ার মতন। যাই হোক২-৩ ঘন্টা পাখির কলতানে মুখরিত পাতায় মোড়া রাস্তা দিয়ে চলার পর পৌছালাম আমাদের দুপুরের গন্তব্য গৈরিবাস|
গৈরিবাসে পৌঁছে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা হাটা দিলাম সেদিন এর গন্তব্য কালপোখরি লেকের দিকে। গৈরিবাসের পর চড়াই যথেষ্ট বেশি, তাই একটু তাড়াতাড়ি পা চালানো শুরু করলাম ভরতদার কথায়। খাওয়া দাওয়ার পর যেন প্রথম ২কিমি আর পা চলতেই চায় না, তাও না থেমে এগিয়ে চললাম পা টেনে | বিকেল ৪টের পর ডিসেম্বর মাসে ওই জায়গা গুলো মেঘে এতটাই ঢেকে যায় যে ১০হাত দূরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে টের পাওয়া ভার| যাইহোক কুয়াশা ঘন রাস্তা দিয়ে কায়াকাট্টা পেরিয়ে আমাদের কালপোখরি লেক পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেলো। আজ হেটেছি প্রায় ১৪কিমি, ট্রেকার্স হাটে পৌঁছে পায়ে প্রায় সারনেই। ভরতদা আগে থেকেই আমাদের জন্য গরমজলের ব্যবস্থা করে রাখে আমরা জুতো খুলে পায়ে সেক দিতে দিতে রাতের খাবার তৈরী | নরম চিকেন সহযোগে রুটি যেন অমৃত| একটু উনোনের ধারে বসে গরম সেক নিয়ে এক কাপ গরম চা খেয়ে আমরা যখন শুতে গেলাম তখন প্রায় সন্ধে৮টা| যদিও বাইরে তখন কালপোখরি এর আশেপাশে গভীর রাত| শুনেছিলাম কালপোখরি লেকের ধারে সূর্যোদয় দেখতে পাওয়া আর স্বর্গের অপ্সরা সামনে দেখতে পাওয়ার অনুভতি একই রকম| তাই আর ভরতদার ওপর আর ভরসা না করে আমরা ভোর ৫টার অ্যালার্ম লাগিয়ে কম্বল চাপিয়ে নিলাম|
চতুর্থ দিন: গন্তব্য কালপোখরি লেকের সূর্যোদয় আর সান্দাকফু
সকাল ৫টায় আমি আর সৌরভ উঠে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হাটা দিলাম ট্রেকারস হাটের থেকে ২০০ মিটার দূরে কালপোখরি লেকের উদ্দেশ্যে। পৌঁছে দেখি সূর্যোদয়ের তখনও কিছু দেরি| এখানে একটা কথা বলে রাখি কেউ যদি কালপোখরি লেক শুনে গুরুদঙ্গমার বা চন্দ্রতাল লেকের মতো ভেবে যান তাহলে একটু নিরাশ হবেন বৈকি| কালপোখরি লেকের উল্টোদিকে সূর্যোদয় দেখা কিন্তু মূল আকর্ষণ| কয়েকশো মাইল মেঘের দলের পিছনে যখন সূয্যি মামা হালকা আলোর ছটা ছড়িয়ে দেখা দেন তখন মনে হয় বৃথা এই চাকুরীজীবন বৃথা এই এম.এন.সি-র সংগ্রাম| জীবনটা এই লেকের ধারে বসে কাটিয়ে দেয়া যায়| সূর্যের প্রথম আলোর ছটায় গেরুয়া রঙের মেঘের ঢেউ থেকে সূর্যের ঝলমলে আলোয় সূর্যের প্রথম আলোর ছটায় গেরুয়া রঙের মেঘের ঢেউ থেকে সূর্যের ঝলমলে আলোয় পুরো পাহাড়ের মাথা আলোয় ভরা যাওয়া অবধি সমস্ত নৈসর্গিক দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দী করতে আমার ফটোগ্রাফার বন্ধু সৌরভ কোনো কার্পণ্য করেনি|যদিও ওই সাবজিরো ঠান্ডায় দস্তানা ছাড়া ক্যামেরা চালানোর সাহস বা পারদর্শিতা কোনোটাই আমার না থাকায় আমি সৌরভকে সাবাসি একটু বেশি দেব |
যাই হোক সূর্যস্নাত হয়ে আমরা উৎফুল্লিত মনে ট্রেকের্স হাটের ফায়ারপ্লেসে খাওয়াদাওয়া করে প্রস্তুত হলাম সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে শেষ ৬ কিমি হাঁটার জন্য| আমার আগের দিন ডান হাঁটুতে একটা মোচড় লাগে তাই হাঁটার গতি ঐদিন একটু শ্লথ ছিল। যদিও থামবো না এই মানসিকতা নিয়ে একটু লেংচে পায়ে মলম লাগাতে লাগাতে এগোতে থাকলাম| যেহুতু জানি দূরত্ব শুধু ৬কিমি তাই আজ আর জিগ্যেস করিনি ঘনঘন "আর কতদূর?" ডিসেম্বর মাসের কনকনানি ঠান্ডায় রাস্তার ছোট অজানা ঝর্ণার জল জমে বরফ| সাবধানে না চললে পপাত ধরণীতল| শেষ ১০০ মিটার পাকদন্ডী বেয়ে সান্দাকফুর টপে ওঠার পর চোখের সামনে যা ভেসে উঠলো তাতে মনে হলো শেষ ৩ দিনের কষ্ট কিছুই না| সামনে দাঁড়িয়ে আছেন থুড়ি শুয়ে আছেন পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্ঘ কাঞ্চনজঙ্গা (৮৫০০ম), স্লিপিং বুদ্ধার আকার নিয়ে| আমার আর তার মাঝে রয়েছে শুধু সাদা মেঘের দল, মনে হচ্ছিলো মিনিট পাঁচেক দৌড়োলে ওই মেঘের ওপর দিয়ে শুয়ে থাকা বুদ্ধকে ছুঁয়ে ফেলা যাবে|
কাঞ্চনজঙ্গার এই রেঞ্জটার যে ভিউ পাওয়া যায় সান্দাকফু টপ থেকে সেটার নাম হচ্ছে স্লিপিংবুদ্ধ.এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্গা রেঞ্জের চূড়াগুলি এমনভাবে আছে যে দেখে মনে হয় একজন মানুষ শুয়ে আছে। মাউন্ট কুম্ভকর্ণর শিখর বুদ্ধের শুয়ে থাকা মুখের আকৃতি দিয়েছে আর বাকি শরীরের অংশগুলি যে পিকগুলি আকৃতি দিয়েছে সেগুলি হলো ককথাঙ, রথং, ফ্রেয়, কাব্রুসাউথ, কাব্রুনর্থ,সিম্ভ, মাউন্টপান্ডিম, তেনজিঙ্খাং, জাপানি, নরসিং| এছাড়াও যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে কাঞ্চনজঙ্গা ছাড়াও পৃথিবীর আরো ৩টি বৃহত্তম শৃঙ্গার দর্শন পাওয়া যাবে এভারেস্ট, লহটসে আর মাকালু|
একটা গোটা দিন ওই পাহাড়ের সামনে বসে কাটিয়ে দিলেও সময় কম পরে যাবে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার সময়টা বাদ দিয়ে এরম অবর্ণনীয় সৌন্দর্যকে ছেড়ে ঘরে থাকতে ১মুহূর্ত মন চাইল না। বিকেল নাগাদ সূর্যাস্তের কিছু আগেই চোখে পড়লো মরা ছায়ায় আসেপাশে পরে থাকা নালার জল জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে. ওই বিকেলবেলায় খাদের ধারের কনকনে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া যেন হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে সোয়েটার জ্যাকেট ভেদ করে|
চায়ের গেলাসে ঠোঁট ডুবিয়ে সাদা বরফের চূড়ায় ডুবন্ত গেরুয়া সূর্যের আলো যে মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে সেটা কথায় বর্ণনা করার বৃথা প্রচেষ্টা করছি মাত্র| প্রতি মুহূর্তে সাদা বরফের শিখরে ঠিকরে পড়া সূর্যের আলোর মায়াময় খেলা দেখতে দেখতে বোধয় চোখের পলক ফেলতে আমরা ভুলে গেছিলাম কিছুক্ষনের জন্য| ক্যামেরা দিয়ে সেই মুহূর্তগুলো বেঁধে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করা সত্ত্বে ও দৃশ্যগুলো বোধহয় মনের মণিকোটাই বেশি তাজা থাকবে সারাজীবন|
সূর্যাস্তের পর পাহাড়ে খুব বেশি কিছু করার থাকে না, আর ঠান্ডা যখন মাইনাস এ থাকে তখন তো সাহস থাকে না। তাই আমরা গিয়ে ভিড় বাড়ালাম কিচেনরুমের আগুনের পাশে গরম পোহাতে মুড়ি চা সোহযোগে। রাতের দিকে আকাশে ছায়াপথে আলোর খেলা দেখতে বেরিয়ে ও বেশিক্ষন থাকতে পারলাম না ওই রক্ত জমানো ঠান্ডা হওয়ার জন্য|
সন্ধে ৮.৩০ এর মধ্যে খাবার খেয়ে আমরা লেপের তলায় মুখ গুজলাম ৪লেয়ার শীতের পোশাক পরে. তা ও যেন বন্ধ ঘরে কোথা থেকে এক পশলা ঠান্ডা হাওয়া যেন হাড়ের মধ্যে সুড়সুড়ি দিয়ে যায় আর আমরা কেঁপে কেঁপে উঠি. মাথায় রয়েছে পরের দিনের সূর্য উদয় দেখার নৈসর্গিক সুখ, তাই এর মাঝে অ্যালার্ম দিতে ভুল হয়নি।
পঞ্চম দিন : গন্তব্য সান্দাকফু সূর্যোদয়
ভোর৪.৩০টার মধ্যে এলার্মের ঘন্টায় জানিনা কোথা থেকে সাহস ফিরে এলো,কিন্তু আমরা সবাই এক লাফে বিছানা ছেড়েছিলাম সূর্যোদয়ের সাক্ষী হব বলে|লজে বলছিল কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম ওই চরম ঠান্ডায় ওদের সময়অনুবর্তীতা দেখে, উঠতে না উঠতেই ধোয়া ওঠা চা হাজির| চা খেয়ে আমরা হাজির সানরাইজপয়েন্টে| কালপোখরিলেকের ধারে সাক্ষী শুধু ছিলাম আমি আর সৌরভ, কিন্তু এই ঠান্ডাতেও সান্দাকফুতে সূর্যোদয়ের লোভ ছাড়তে পারেনি আপামর ট্রেকার আর ফটোগ্রাফার| আমরাও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে বসে পড়লাম ক্যামেরা হাতে সুজ্জি মামার অপেক্ষায়, যদিও আসল উদ্দেশ হলো স্মৃতি গুলো না হারাতে দেয়া|
নিশুতি রাতের তমসা ঘন অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলোর আভাসে সামনের মেঘের মাঝে যেন হোলি খেলা শুরু হয়ে গেলো| প্রতি মুহূর্তের আলোর খেলা আমার লেখনীতে বর্ণনা করা দুরহ তাই পাঠকদের কাছে অনুরোধ রইলো যে সম্ভব হলে সশরীরে একবার এই সান্দাকফু ঘুরেই আসুন| মনে হবে সত্যি যদি স্বর্গ বলে কিছু থাকে তাহলে এই সামনের মেঘের মাঝেই কোথাও লুকিয়ে আছে| কিন্তু সুখের মুহূর্ত সর্বদা ক্ষণস্থায়ী, তাই সেই বহু আখাঙ্খিত সূর্যোদয় শেষ, চারদিক ঝলমলে করে সূর্যদেব উঠে পড়লেন|
কিছু আরো নিজেদের ছবি তোলার পর আমরা লজে ফিরলাম প্রাতরাশ সেরে ফেরার পথের উদ্দেশে. সান্দাকফু থেকে ট্রেক করে ফিরতে হলে ট্রেক করে নামা যায় বা ওখান থেকে ল্যান্ডরোভার ভাড়া করে সিধে মানেভঞ্জন চলে আসা যায় ঘন্টা ৪একের মধ্যে| ল্যাদখোর মানুষ আমরা তাই স্বর্গের দর্শনের পরে আর হেটে ফেরার ইচ্ছা রইলো না, তাই আমরা লজের ল্যান্ডরোভারটা ভাড়া করে ফেরত আসার সুবিধাজনক প্ল্যানটাই করে ফেললাম|কিন্তু যে রাস্তা দিয়ে হেটে উঠেছি সে রাস্তা ধরে গাড়ি করে নামাটা খুবই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। আসলে ওখানে রাস্তা বলতে শুধু পাথর দিয়ে বাঁধানো ভাঙাচোরা একটা পাকদন্ডী| খোলা দরজার পাশে বসে থাকতে প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি বেরিয়ে পরে যাবো। যাই হোক নেমে আসার সময় কিন্তু মন অনেকটাই খারাপ হয়ে যায় সকলের, যতই পায়ে ব্যাথা হোক sesh ৩ দিনে এই পাহাড়ের দুর্গমরাস্তাগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমরা। তাই আমরা পাহাড়কে এইবারের মতো শেষ বিদায় জানিয়ে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে গেলাম শিলিগুড়ি দিকে|
Name - Dweep Saha
Age - 32
Profession- IT Professional
City - Kolkata
Hobbies - Rock Climbing, Boxing, Travelling
Travel Experience - Sandakphu trek, Roopkund trek, Kheerganga trek, Phoktey dara trek, Biking and traveling to places like Sikkim, Himachal Pradesh, Andaman etc.