"বেনারস" নামটা শোনা ইস্তক স্বস্তিতে ছিলাম না। যেদিন শুনলাম মাত্র ৩ দিনের ঝটিকা সফর হবে, তাও আবার শুধুমাত্র বিশেষ কর্ম উদ্দেশ্যে, এবং আমার যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তাই একেবারে মেজাজ বিগড়ে ছিল। শেষমেষ অবশেষে ভাগ্যে শিকে ছিড়লো।
বেনারসের শীত ! গুজরাট থেকে ফিরেছি দু সপ্তাহ হয়নি, যাবার আগে সকলেই বলল - "ও বাবা:, ওখানে তো এখন খুব ঠান্ডা রে, বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছিস?!!" তবুও আশা ছাড়িনি। এ যে বেনারস, আমি তো ওর আনাচ-কানাচ ও দেখব, দীর্ঘ সময় নিয়ে একদিন ওর পুরোটা আত্মস্থ করব, তার আগে তিন দিন একটু চেখে দেখে আসি।
খুব ভোরে দীন দয়াল উপাধ্যায় স্টেশনে নেমে অটো করে নদী পেরিয়ে বেনারস পৌঁছাই। উঠি দশাশ্বমেধ ঘাটের খুব কাছের সুন্দর বাড়ির মতন একটি হোটেলে। জানতাম খুব বেশি কিছু দেখা হবে না, তাই দুপুরে বের হলাম বেনারসের বিখ্যাত ঘাট দেখতে।i
কাশী বিশ্বনাথ ছাড়াও বেনারস তার ঘাটে ঘাটে সমুজ্জ্বল। প্রত্যেকটি ঘাটের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও গল্প রয়েছে। ঘাটের পাশে সেই কোন অতীতকাল থেকে রাজা ,মহারাজা ,রানী, সম্রাট ,তাদের পেয়াদা ,জমিদার ,শিল্পী ,ধনী ব্যক্তি যে যা পেরেছে একেকটা দুর্গ, কেল্লা, মহলের মত অট্টালিকা খাড়া করেছে, ওগুলো আবার কালের নিয়মে বদলেছে ও। অধিকাংশ হোটেলে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সবার আগে তাই ওদিকেই চোখটা আটকালো। ওগুলো দেখতে দেখতে চলেছি। আর অপর দিকে গঙ্গা ও তাতে সারি সারি নৌকা বাঁধা বেনারসের চিরপরিচিত যাকে বলে সিগনেচার দৃশ্য। কিন্তু ওই অট্টালিকার সারি আর গঙ্গার নৌকার সারির মাঝখানের বাঁধানো ঘাট গুলি যেকোনো সংবেদনশীল মনকে আকৃষ্ট করবে। কারণ ওগুলি কেবলমাত্র
কালের গণ্ডি পেরোনো ঘাট নয়, ওগুলোতে যে অন্য আরেকটি ভারতবর্ষের গল্প লুকিয়ে আছে ।প্রায় প্রতিটি রাজ্যের জনসমাগম ঘটেছে এখানে। নিজও নিজও বৈশিষ্ট্য ও রীতি অনুযায়ী ক্রিয়া সম্পাদন তো চলছেই, আবার নিছক ভ্রমণের আনন্দেও মেতে রয়েছে তারা। তাদের বিচিত্র বর্ণের ও বিভিন্ন ধরনের পোশাক, সমগ্র ঘাটকে অত্যন্ত বর্ণময় করে তুলেছে। একটু এগিয়ে যেতেই আমার ভুল ভাঙলো। না: !
এইতো শুধু ভারত বর্ষ নয়, এ যে এক খন্ড পৃথিবী। কত ভিনদেশী যে বেনারসে ভ্রমণ, শিল্প ,স্থাপত্য ,শিক্ষা এবং অবশ্যই ধর্মের টানে ভিড় করেছে তার ইয়ত্তা নেই। অবাক করার মতো বিষয় হলো ঘাটে ঘাটে ভারতীয় ও বিদেশী জটাধারী সাধুদের নিঃশব্দ সহাবস্থান। ওনাদেরকে জরিপ করতে করতে আমিও নিঃশব্দে তাদের পেরিয়ে গেলাম। তখনো রবি অস্তাচলে যায়নি, সামনে এক বিদেশি একা একা একটা ধাতব হাঁড়ির মতো অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র
অতি অপূর্ব সুমিষ্ট ঝংকার তুলে সুর সাধনা করে চলেছে। চারিদিকে অল্প ভিড় তাকে ঘিরে ধরলেও সেদিকে শিল্পীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এগিয়ে চললাম। সামনে এবার আমার আগ্রহের বিষয়। বেশ কয়েকজন শিল্পী জলরঙে ঘাটের নানা চিত্র একে চলেছে ও তাদের উৎকৃষ্ট শিল্প নিদর্শন মেলে রেখেছে। এদিকে বারবার সতীর্থদের তাড়া খাচ্ছি বলে অল্প সময় ব্যয় করেই এগিয়ে চললাম অসি ঘাটের দিকে। ইতিমধ্যে পথচলতি বাঁশিওয়ালার বাঁশি, নিত্যান্ত গেঁয়ো বিহারীর রেওয়াজ হীন গলায় সুন্দর ভজন, ও মাড়োয়ারি চা এর স্বাদ আস্বাদন হয়ে গেল। কিন্তু অসি ঘাটের নিকটবর্তী কুস্তির আখড়ায় এসে হতাশ হলাম। ভোর ব্যতীত কুস্তি দর্শন সম্ভব নয় তাই পাটে বসা সূর্যের সাথে আমরা দশাশ্বমেধ ঘাটের সোপানতলে ফিরে এলাম গঙ্গা-আরতী দেখার উদ্দেশ্যে।
এখন পাশাপাশি অনেকগুলি ঘাটেই গঙ্গা-আরতী হয় বলে দর্শনার্থীদের ভিড় যথেষ্ট শৃঙ্খলিত। একেবারে সামনেই বসার জায়গা পেলাম । ঘাট তীর্থযাত্রী,বিদেশি ও চিত্রগ্রাহক এ ছয়লাপ। ৫ জন ব্রাহ্মণ বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ ও ভজন গানে অপূর্ব ছন্দবদ্ধ আরতী আরম্ভ করলেন। উপস্থিত দর্শনার্থীরাও তাতে যোগ দিলেন। বাতাস ধুপ ,ধুনো ও কর্পূর এর সুগন্ধে ভরে উঠেছে। এমন একটি অনন্য সুন্দর ও আধ্যাত্মিক আবহ সৃষ্টি হল যে শরীর ও মন স্থির ও শান্ত হয়ে যায়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সকলে আরতী দর্শন করলাম। আরতী সমাপ্ত হলেও অত বড় জনসমাগমে কোন কোলাহল হলো না। সকলেই তখন আধ্যাত্মিকতার গভীর প্রশান্তিতে আচ্ছন্ন।
পরেরদিন অত্যন্ত ভোরবেলায় সতীর্থরা কুস্তির আখড়ার দিকে গেল। মধ্য জানুয়ারির কড়া শীত। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বের হবার সাহস পেলাম না। ওরা ফিরে এসে বলল ওখানে ঊষায় যে গঙ্গা-আরতী হয় তা নাকি সন্ধ্যারতী কেও হার মানায়। ওটা কে পরের বারের জন্য তালিকায় জমিয়ে রাখলাম।
বেনারস কে চিনতে হলে ওর গলি ধরে হাঁটতেই হবে । তাই পরদিন একটু ঘাট উপভোগ করে গলি ধরে হাঁটা শুরু করলাম। সত্য বেনারস!! কি বিচিত্র এই গলি!!! পৃথিবীর প্রধান দশটি প্রাচীনতম শহরেরএকটি হলে বেনারস। এর প্রাচীনত্ব এই গলিতেই দেখতে পেলাম। সংকীর্ণ গলিপথ, অধিকাংশই কবেকার পাথরে বাঁধানো। এখনো অনেক গৃহ সময়কে হার মানিয়ে প্রাচীনত্বের বনেদিয়ানা বজায় রেখেছে তার কড়িবর্গায়, কাঠের জানালার খড়খড়িতে আর সুবিশাল কারুকার্যময় কাঠের দরজায়। কোথাও পরপর সিঁড়ি, কোথাও সাদাকালো চক মেলানো বারান্দা , কোথাও ঝুল বারান্দার অপূর্ব কারুকার্যময় লোহার রেলিং ও যত্রতত্র শিবের মন্দির আর পাঁচটা শহর থেকে বেনারস কে আলাদা করে। আছে দেশী-বিদেশী (আলাদা আলাদা দেশেরও) ক্যাফে রেস্তোরাঁ ও স্যুভেনির শপ ।
সব দেখতে দেখতে চলেছি। উল্লেখজনক ভাবে নানা বাদ্যযন্ত্রের দোকান ও তাতে বিদেশিদের যথেষ্ট আনাগোনাও লক্ষ্য করা গেল। এছাড়া গলি-ঘুপচি র গোলকধাঁধায় যত্রতত্র চায়ের দোকান ও খাবারের দোকান তো আছেই। আর হ্যাঁ সেটির ও দেখা পেলাম যে সম্পর্কে লোকমুখে অনেক কথা শুনেছিলাম " কাশীর ধর্মের ষাড় " !
গলি পেরিয়ে পড়ন্ত বিকেলের দোরগোড়ায় সকলে বেশ বড় একখানি নৌকা নিয়ে গঙ্গায় ভেসে পড়লাম। গঙ্গায় নৌবিহার বেনারস ভ্রমণের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। দূর থেকে পুরো বেনারস দেখতে দেখতে অদ্ভুত অনুভূতি হল। মনে হল যেন সহস্রাব্দ পেরিয়ে সুদূর অতীতে পৌছে গেছি কোন এক অজানা টাইম মেশিনে চড়ে
দূরে ওই মহলগুলিতে যেন রাজা-মহারাজাদের আনাগোনা শুরু হল। হয়তো এখনি তারা সপার্ষদ নৌবিহারে বেরোবেন, সখি পরিবেষ্টিত হয়ে রানী অলিন্দে মুখ রেখে বৈকালিক হাসি -তামাশায় মেতে উঠবেন। ক্রমে ক্রমে বিকেলের সমাপতন ঘটলো রক্তিম আভায় ।
মণিকর্ণিকা ঘাট-এর চিতাগ্নিও যেন তেমনই রক্তিম। হয়তো এখনই ওই মহল গুলিতে জ্বলে উঠবে ঝাড়বাতি, হয়তো মন্দিরের শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বনি সাথে মিশে যাবে খেয়াল, ঠুমরি,ইমনের তান, মুজরার নুপুরধ্বনি! সম্বিৎ ফিরল ঘাটের বর্ণময় গ্রাফিতি গুলি দেখে। ওগুলো কিছু বিদেশিদের করা আবার কিছু "নমামি গঙ্গে "র প্রজেক্ট করা। এত সুন্দর গ্রাফিটি আমি আর কোথাও দেখিনি। অতঃপর ফিরে এলাম।
সেই সন্ধ্যায় স্থানীয় খাবার চেখে দেখার এক টুকরো সময় পেয়ে গেলাম। অলিগলি খুজে খুজে রাবড়ি, ল্যাংচা ,রসগোল্লা আর ধোসা খাওয়া হলো। বাকি খাবার গুলো দেখে রেখেছি পরের বারে খাবার জন্য।
ফেরার দিন একেবারে কাকভোরে বের হলাম। বেনারস তখনও সম্পূর্ণ জেগে ওঠেনি। আমার কাঁধে ঘুমন্ত মেয়ে আর ব্যাগ, আর পতি মহাশয় এর একটা ঢাউস ক্যামেরা ব্যাগ, একটা রুকস্যাক আর ততোধিক বড় একটা ট্রলি হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে গলি পেরিয়ে দুজনে বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। গোধূলিয়া মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতে খুব বেগ পেতে হবে। চারিদিকের আলো-আঁধারিতে মাঝে মাঝে টুংটাং করতাল আর ভজনের শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ দেখি এক দঙ্গল বিদেশী ঘাটের দিকে চলেছে। একটু এগোতে আরো কিছু, সঙ্গে কীর্তনের দল। বাবা !! এরপর তো আর বিস্ময়ের শেষ রইল না। দেখি দলে দলে মিছিলের মতো বিদেশীরা ঘাটের দিকে চলেছে। ইউরোপিয়ান ,আমেরিকান ,চাইনিজ ,কোরিয়ান, আফ্রিকান সকলেই আছে। অধিকাংশই বয়স্ক। জীবন সায়াহ্নে এসে হয়তো তারা বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে।পুরো রাস্তা জুড়েই বিদেশি। এছাড়া ব্রাহ্মণ , টিকিধারী পন্ডিত ও কীর্তনীয়া রা তো আছেই। দাঁড়িয়ে হা করে দেখছি। পতি মহাশয় কে জিজ্ঞাসা করলাম" হ্যাঁগো, ওরা সব কোথায় যাচ্ছে?" উত্তর এল"বিশ্বনাথের মন্দিরে, আর মৌনী অমাবস্যা র পুন্য গঙ্গাস্নানে"।একটু থেমে _"ও তুমি তো আবার ভোরে বেনারসের ঘাট ই দেখনি, এবারে চলো"। পরে যতক্ষণই হেঁটেছি বিপরীত দিকে বিদেশিদের মিছিলও হেঁটেছে। আমি ইহ জীবনে একসাথে এত বিদেশী কখনো দেখিনি। ভাবলাম বেনারসের কি মহিমা। অথচ কত কিছু আমার অনুভবের বাইরে থেকে গেল। এমনকি বেনারসি শাড়িটাও কেনা হয়নি। অটোতে উঠতে যাবো যখন -এই যাঃ বেনারসি পান তাও তো খাওয়া হলো না!!!
Name- GOPA SARKAR
Profession- ASSISTANT TEACHER
City- ATHPUR
Hobbies- PAINTING, TRAVELLING & READING BOOKS.
Previous Tours- DIFFERENT PLACES IN BENGAL, SIKKIM, MP, BENARAS, GUJRAT, CHENNAI, KUMAUN, GARWAL, ANDHRA PRADESH, ORISSA & DELHI.